Thursday, August 23, 2012

বঙ্গবন্ধু কেন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন?

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র চার দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাংলাদেশের তারিখ বইয়ে এ রকম একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ দেখে আমরা অনুসন্ধান চালাই।
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর কী ধারণার ভিত্তিতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। কারণ, সেদিন যে নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল, আগামী বছরেই শেখ হাসিনার হাতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে, বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ বহাল রেখে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের রাত ১২টা ১ মিনিটে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল গণপরিষদ। এর সমাপ্তি অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্বের বুকে তাঁরা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের তখনকার অনেকের কাছে জানতে চাইলাম, সাধারণ নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী মুজিব কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা মন্তব্য করেননি। এমনকি অনেকে স্মরণও করতে পারেননি যে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল।
সংসদীয় রীতি হচ্ছে, কোনো প্রধানমন্ত্রী আস্থা ভোটে পরাস্ত হলে পদত্যাগ করবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলে তিনি শুধু সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে না। তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে। কিন্তু তিনি তাঁর উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত স্বপদে আপনাআপনি টিকে থাকবেন।
১৯৭২ সালে গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের জন্য নয়। কারণ, গণপরিষদের একমাত্র ম্যান্ডেট ছিল সংবিধান প্রণয়ন। নতুন সংবিধান কার্যকর করার প্রয়োজনেও গণপরিষদ ভাঙা হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো কার্যকরী গণপরিষদ বা সংসদ ছিল না। ৭ মার্চে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল।
কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভের পর মাত্র চার দিনের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল না।
ভারতে ২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ১৩ মে লোকসভা নির্বাচন হলো। এর পাঁচ দিন পরে ১৮ মে সকালে ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকার রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলকে চতুর্দশ লোকসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেবে। ওই দিনই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত বিদায়ী মন্ত্রিসভাকে দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ জানান। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু হয়তো এই রীতিটি অনুসরণ করেছিলেন।
বর্তমানে বড় বিতর্ক দেখা দিয়েছে যে সংসদ রেখে আরেকটি সংসদ সৃষ্টি করা যাবে কি না। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ড. শাহ্দীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল প্রমুখ এই বিধানের সমালোচনা করছেন। ড. কামাল হোসেনও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার ক উপদফা অবশ্য সংসদ না ভেঙে সংসদ গড়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। ১৯৭২ সালে সংবিধানে এই বিধান সংযোজনের পর এটি প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৫ সালে সংসদ ভেঙে গেল। এরপর সংসদ নির্বাচন হলো ১৯৭৯ সালে। সেই সংসদ মেয়াদ পুরা করার আগেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভেঙে গেল। এরপর জেনারেল এরশাদের ১৯৮৬ সালের ৭ মে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে গেল। ১৯৮৮ সালের সংসদের পাট ১৯৯০ সালেই চুকল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত ষষ্ঠ সংসদ মার্চে ভেঙে যায়। সপ্তম সংসদ থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় সংসদ নির্বাচন সংসদ না থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯১ সালে সংবিধান সংস্কারের বিরাট সুযোগ এসেছিল। সেদিন রাজনীতিবিদেরা সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতির ঐতিহ্যবাহী এখতিয়ারকে বিনা আলোচনায় ছুরিকাহত করেছিলেন। দ্বাদশ সংশোধনীতে তাঁরা লিখেছিলেন যে রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ‘লিখিত’ পরামর্শে সংসদ ভাঙবেন। বাহাত্তরের সংবিধানে এটা ছিল না। অন্যান্য সংবিধানেও দেখি না। এই ‘লিখিত’ শব্দটি সংযোজন করে বিএনপি কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর একটা হামলা চালিয়েছিল। কেন এটা হামলা, তা পরে বলব। তবে আওয়ামী লীগের তা খুব মনঃপূত হয়েছিল। ১৫তম সংশোধনীতেও তারা ওই ‘লিখিত’ কথাটি সযত্নে রেখে দিয়েছে। এরা যে বহু ক্ষেত্রে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তা আমরা এমনসব কাণ্ডকীর্তি থেকে প্রমাণ পাই। আজকের বিএনপি সংসদ রেখে সংসদ নির্বাচন করাসংক্রান্ত যে বিধানের জন্য আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করছে, সেটা কিন্তু তারাই ১৯৯১ সালে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে টুকলিফাই করেছিল। বিএনপি এখন এমন ভাব নিচ্ছে যে সংবিধান কাটাছেঁড়াসংক্রান্ত যত দোষ আওয়ামী লীগই তা করেছে।
১৯৭৩ সালে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা আমাদের বিস্তারিত জানা দরকার। ১৩ মার্চ ১৯৭৩। মঙ্গলবার। ইত্তেফাক পত্রিকার শীর্ষ শিরোনাম ছিল, ‘বর্তমান মন্ত্রিসভা চার দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুক্রবার নয়া মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ।’ এই খবরে বলা হয়, ‘১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে কাজ করে যেতে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মুজিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।’
এখানে বলা দরকার যে ইত্তেফাক-এর ওই প্রতিবেদনটি ভ্রান্তিকর ছিল। কারণ, তারা লিখেছিল, ‘বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ইচ্ছানুযায়ী বিদায়ী সরকার “কেয়ারটেকার সরকার” হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিধানও সংবিধানে আছে।’ অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে এ রকম কথা লেখা ছিল না। তবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা অস্বাভাবিক ছিল না। দৈনিক আজাদ এনা পরিবেশিত খবরের শিরোনাম দিয়েছিল, ‘মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, রাষ্ট্রপতির অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ চালাবেন’। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চাইলে ১১ আগস্ট লেখককে তিনি বলেন, ‘আমি যে পদত্যাগ করার দিনটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম, সেটা স্মরণ করতে পারি। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন যে যেহেতু নির্বাচনে তিনি জিতেছেন, এখন সরকার গঠন করতে হবে। ওই চার দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এবং সেই হিসেবে তিনি সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।’
আমরা লক্ষ করি যে বিরোধী দল তখনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলেছিল। ১৯৭৩ সালের ৬ জানুয়ারি আতাউর রহমান খান নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’ অবশ্য তিনিও যে অতিরঞ্জন করতেন তার প্রমাণ হলো, তিনি বলেছিলেন, ‘১০ ভাগ লোকও ভোট দিতে আসবেন না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. ইদ্রিসকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল যে ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে। কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হবে না। ন্যায়নীতি, সততা বজায় থাকবে।’ নামে মাত্র থাকা তখনকার বিরোধী দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতির মন্তব্য নিয়ে আজাদ-এর একটি শিরোনাম ছিল, ‘তথাকথিত বিরোধী দলরা স্বাধীনতা নস্যাতের ষড়যন্ত্র করছে: জিল্লুর’।
যাহোক, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে আগামী বছর আরেকটি সংসদ নির্বাচন করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে আসি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে বলেছেন, ‘মেয়াদ অবসানের ৯০ দিন আগে তো সংসদের কোনো অধিবেশন বসছে না।’
বঙ্গবন্ধু হয়তো তেমন কোনো বিতর্ক ছাড়াই নির্বাচন পর্যন্ত গণপরিষদ টিকিয়ে রাখতে পারতেন। তিয়াত্তরের নির্বাচনের কয়েক দিন পরে তিনি সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘তাঁরা চাইলে নির্বাচন ছাড়াই আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন।’ কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা স্মরণ করব যে তিনি গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। সুতরাং, মুজিবের জমানায় সংসদ সদস্য হিসেবে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হননি। ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর অপরাহে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে নতুন সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী মুজিবসহ মন্ত্রিপরিষদ ও প্রধান বিচারপতি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের সমাপ্তি টেনে বলেছিলেন, ‘আপনারা এমসিএগণ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বিশ্বের ইতিহাসে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর হতে আর কেউ এমসিএ হিসেবে পরিচিত হবেন না। এবং গণপরিষদও স্বাভাবিকভাবে ভেঙে যাবে। (আজাদ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২) এদিন ইত্তেফাক-এর রিপোর্ট ছিল, ‘আমরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। পুনরায় ফিরে যাব নতুন ম্যান্ডেটের জন্য।’
নতুন ম্যান্ডেটের জন্য বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানের বর্তমান বিধানের অধীনেও সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের দাবি না মেনে এবং নিজে পদত্যাগ না করেও সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দিতে পারেন। এর ফলে তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বলতে পারবেন যে ‘আমরা নতুন ম্যান্ডেট পেতে সংসদ ভেঙে দিয়েছি।’
আমরা বিশ্বের বহু সংবিধান মিলিয়ে দেখেছি। সংসদ রেখে সংসদ তৈরি করার বিধানসংবলিত ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার মতো কোনো দফা নজরে এল না। ভারতের সংবিধানেও এ রকম দফা নেই। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানেও ছিল না। তবে লোকসভা রেখে লোকসভা করার বিধান আছে ভারতের নির্বাচনী আইনে।
বাংলাদেশ সংবিধানে কী করে এটা এল? বিষয়টি ড. কামাল হোসেনের নজরে নিয়েছিলাম। তিনি মন্তব্য করেননি। আমি এত দিন টিভি টক শোতে বলে আসছিলাম, এটা বুঝি বাহাত্তরের সংবিধানে অসাবধানতায় ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে আলাপ করে আমি হতবাক। তিনি বললেন, আমিই এই অনুচ্ছেদটির রূপকার। অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা এটা সংবিধানে যুক্ত করেছিলাম।
আগামীকাল: সংসদ রেখে সংসদ তৈরির ভ্রান্তি
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক। তারিখ: ২৪-০৮-২০১২ | প্রথম আলো
mrkhanbd@gmail.com

Saturday, August 11, 2012

ফেসবুকের ছায়াবন্ধু, নাকি সামনের কায়াবন্ধু!

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাকে একট গল্প শুনিয়েছেন। গল্প নয়, সত্য ঘটনা। চীনের এক দম্পতি কম্পিউটারে এক নতুন খেলা পেয়েছেন। একটা বাচ্চাকে লালন-পালন করতে হয়। তাঁরা সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকেন। এই বাচ্চাকে খাওয়ান, পরান, গোসল করান। এই বাচ্চার প্রতি তাঁদের যত্নের সীমা নেই। তাঁরা একেবারেই মগ্ন হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের একটা বাচ্চা ছিল। খেলায় মগ্ন এই দম্পতি নিজেদের বাচ্চার কথা ভুলে গেলেন। একদিন দেখা গেল, বাচ্চাটা মরে পড়ে রয়েছে।

২.
জ্যাক দেরিদা রুশোর স্বীকারোক্তিমূলক আত্মজীবনী কনফেশনস থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতীক বা বিকল্প কখনো কখনো নিজেই প্রধান হয়ে ওঠে। রুশো কৈশোরে যে বাড়িতে থাকতেন, সেই গৃহকর্ত্রীকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সেই ম্যাডাম যে বিছানায় শুতেন, রুশো সেই বিছানাকে চুমু দিতেন, আদর করতেন তাঁর চেয়ারকে, মেঝেকে, পর্দাকে। কারণ, ওসব ছিল তাঁর ম্যাডামের বিকল্প। সামনে ম্যাডাম নেই, কিন্তু এসব বস্তুর মাধ্যমে রুশো তাঁর ম্যাডামের অভাব পূরণ করছেন। কিন্তু একদিন ম্যাডাম তাঁর সামনে, খাচ্ছেন। রুশো বললেন, খাবারে একটা চুল। ম্যাডাম খাবারটা মুখ থেকে বের করতেই রুশো সেই খাবার নিজের মুখে পুরলেন।
এখানে তো ম্যাডাম সামনে আছে, তাহলে কেন রুশো ম্যাডামের মুখের খাবার মুখে পুরলেন।
ম্যাডাম, যাঁকে রুশো বলতেন ম্যামান, তিনি ছিলেন রুশোর মায়ের বিকল্প। তারপর মায়ের চেয়ে ম্যাডামই মুখ্য হয়ে উঠলেন। তারপর ম্যাডামের চেয়ে বিভিন্ন বিকল্পই মুখ্য হয়ে উঠল।
দেরিদা দেখিয়েছেন, এভাবে বিকল্পই প্রধান হয়ে ওঠে।
দেরিদার বক্তব্য হলো, লেখা মুখের কথার বিকল্প নয়, পরিপূরক নয়, লেখাই আসল। টেক্সটই আসল। আমরা কি সেই যুগে প্রবেশ করলাম, যেখানে বাস্তবের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ভারচুয়াল বাস্তবতা, যেখানে রক্ত-মাংসের বন্ধুর চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে স্ক্রিনে দেখা (ও পড়া) ছায়াবন্ধুটি?
সুমনা শারমীন লিখেছিলেন, মা পাশের ঘরে অসুস্থ পড়ে আছেন দিন সাতেক ধরে, ছেলে একবারও তাঁকে দেখতে যায়নি, কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রে ফর মাই মাদার, শি ইজ সিক। মাদার, গেট ওয়েল সুন।

৩.
প্রযুক্তি, যোগাযোগের বিকল্প মাধ্যমগুলো আমাদের কাছে জ্যান্ত মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কি না?
আমার সামনে আমার বন্ধু বসে আছেন, মা বসে আছেন, বাবা বসে আছেন, ডাক্তার বসে আছেন, এই সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আমরা সেটা আগে ধরাটাকেই কর্তব্য বলে মনে করি।
আমার জলজ্যান্ত বন্ধু সামনে বসে আছে, কিন্তু তাকে রেখে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, আমি এখন বন্ধুর সঙ্গে কফি খাচ্ছি।
পাঁচজন স্কুলবন্ধু, তাঁদের দেখা হলো আজ ২২ বছর পরে, তাঁরা আজ একটা জায়গায় একত্র হচ্ছেন, কী ভীষণ উত্তেজনা তাঁদের মধ্যে। দেখা হওয়ার পরে পাঁচজনই পাঁচটা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কেউ ফেসবুক করছেন, কেউ বা গেমস খেলছেন, কেউ বা খুদেবার্তা পাঠাচ্ছেন, কেউ বা জরুরি ই-মেইল সেরে নিচ্ছেন, কেউ বা চ্যাট করছেন দূরবর্তী কারও সঙ্গে।
সামনে সমুদ্র, একটু পরে অস্ত যাবে সূর্য, সেদিকে খেয়াল নেই। আমি স্ট্যাটাস দিচ্ছি, আহ্, লাইফ ইজ বিউটিফুল, আই অ্যাম ইন আ প্যারাডাইস।
প্রেমিক দেখা করতে গেছে প্রেমিকার সঙ্গে, কোনো নির্জন জায়গায়। দুজনের হাতে দুটো মোবাইল ফোন, দুজনেই নিজ নিজ ফোন নিয়ে ব্যস্ত, সারাক্ষণ বুড়ো আঙুল চলছে।
আমি মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে একজন পথিককে এসএমএস করতে দেখেছি।
আমি বিয়ের আসরে বসা বরকে এবং বউকে দেখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।

৪.
একটা কৌতুক ছিল। একজন সম্ভাব্য পাত্র ঘটককে বলল, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই, যে কিনা আমাকে আমার ইচ্ছামতো বিনোদন দেবে, আমি চাইলে সে কথা বলা বন্ধ করবে, চাইলেই গান গাইবে, বা নাচবে, বা কথা বলবে, আবার আমি যখন চাইব তখনই সে ঘুমিয়ে পড়বে, আমি চাইলেই সে অন হবে, আমি চাইলেই সে অফ হবে।
ঘটক বললেন, ভাই, আপনি একটা টেলিভিশনকে বিয়ে করুন।
এই কৌতুককে আধুনিকায়ন করে বলা যায়, ভাই, আপনি একটা ইন্টারনেটকে বিয়ে করুন।
কিন্তু তা বলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আমি চাইলে ইন্টারনেট অফ হবে বটে, কিন্তু আমার চাইবার শক্তি যে থাকবে না। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে মনে হবে, যাই না, একটু ফেসবুকটা চেক করি, দেখি না স্ট্যাটাসে কয়টা লাইক পড়ল।

৫.
এই কৌতুক আগেও শুনেছেন। আবার শুনতে পারেন, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কৌতুক।
গৃহপরিচারিকা কয়েক দিন বিনা নোটিশে অনুপস্থিত থাকল। তারপর কাজে ফিরে এলে গৃহকর্ত্রী তাকে বললেন, তুমি কয়েক দিন কাজে আসোনি, ব্যাপার কী?
‘দেশে গেছিলাম, আপা।’
‘দেশে গেছ। বলে যাবা না?’
‘ক্যান? আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলাম, তিন দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি, আপনে দেখেন নাই?’
‘ওমা! তোমার আবার ফেসবুকও আছে নাকি?’
‘কেন? আপনি জানেন না? আপনার বর তো আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট দিছে: মিস ইউ।’

৬.
তলস্তয়ের থ্রি কোশ্চেনস গল্পে পড়েছিলাম—
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী?’
‘এখন। এই মুহূর্ত।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?’
‘এখন যা করছি।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে?’
‘যিনি এখন আমার সামনে বসে আছেন।’
প্রিয় পাঠক, আমাদের মনে হয় তলস্তয়ের এই গল্পটা আরেকবার গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, এখন যা করছি, এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আর এখন যিনি আমার সামনে আছেন তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনার সামনে রক্ত-মাংসের যে মানুষটি আছেন, তাঁর কথাই নিশ্চয়ই তলস্তয় বলেছেন, দূরবর্তী শত শত ছায়াবন্ধুর কথা নিশ্চয়ই তিনি বোঝাতে চাননি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথম আলো | তারিখ: ০৭-০৮-২০১২

Thursday, August 11, 2011

ভালোবাসার কাঙাল :রবীন্দ্রনাথ

গোলাম মুরশিদ
মার্কিন ঔপন্যাসিক ও সমালোচক হেনরি জেমস [১৮৪৩-১৯১৬] লিখেছেন যে, একজন কবি অথবা সৃজনশীল সাহিত্যিক যা কিছু লেখেন, তার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে নিজের কথাই লেখা থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এর ঠিক উল্টোকথা : 'কবিরে পাবে না তাঁহার জীবনচরিতে।' অবশ্য এ কথা লিখলেও তিনি বারবার নিজের কথাই লিখেছেন। নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে_ কবিতায়, গানে, উপন্যাসে, নাটকে, এমনকি প্রবন্ধে এবং নিজের আঁকা ছবিতে। ব্যক্তিগত জীবন এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি বারংবার অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার সেই নিবিড় এবং প্রগাঢ় অভিজ্ঞতাই তাকে অত উদ্বুদ্ধ এবং উচ্ছ্বসিত করেছিল লিখতে।
তিনি যে পরিমাণ লিখেছেন এবং যত ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে লিখেছেন যে, তাতে তাকে কোনো এক বিশেষ ধরনের কবি বা সাহিত্যিক বলা সম্ভব নয়; যেমন প্রকৃতির কথা প্রচুর লিখলেও, তাকে প্রকৃতির কবি বলে আখ্যায়িত করা যায় না। তবে যে তিনটি বিষয়বস্তু বারবার তার রচনায় ফিরে ফিরে এসেছে, সেগুলো হলো পূজা, প্রেম আর প্রকৃতি। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার কথা মনে রাখলে লক্ষ্য করা যায় যে, বয়স যত বেড়েছে, ততই তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সরে গিয়ে মানুষের ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। গানে তিনি বারংবার নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় এবং সান্ত্বনা খুঁজেছেন। তা সত্ত্বেও তাকে যদি কোনো বিশেষ ধরনের কবি অথবা শিল্পী বলে চিহ্নিত করতেই হয়, তাহলে সম্ভবত প্রেমের কবি অথবা প্রেমের শিল্পী বলেই নাম দিতে হয়। কারণ প্রেম কেবল তার শত শত প্রেমের গান আর কবিতায় প্রকাশ পায়নি, তার প্রকৃতি এবং পূজাও প্রেমের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এই ভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় না।
যেমন, 'ভগ্নহৃদয় কাব্য' তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বউদি কাদম্বরী দেবীকে_ একটি কবিতার মাধ্যমে_ 'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা'। ১৮৮০ সালের কার্তিক সংখ্যা 'ভারতী'তে এটি ছাপা হয় কবিতা হিসেবে। কিন্তু তার তিন মাস পরে এটি প্রথম গাওয়া হয় মাঘোৎসবের সময়ে, ব্রহ্মসঙ্গীত হিসেবে। দু-এক পঙ্ক্তির কেবল পরিবর্তন করতে হয়েছিল মূল কবিতার।
তবে তার প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিল অনেক বেশি। তিনি বড় হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিল ব্রাহ্মরুচি, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন উদারপন্থি বলে। রবীন্দ্রনাথ তার থেকে এক পা বেশি বাড়িয়েছিলেন। লন্ডনে ঠাকুরদার কবরটির সংস্কার করা দূরে থাকে, কেনসাল গ্রিনে গিয়ে একবার দেখেও আসেননি বলে মনে হয়। সত্যেন্দ্রনাথ কিন্তু গিয়েছিলেন। কেবল তা-ই নয়, দ্বারকানাথের সব ব্যবসায়িক কাগজপত্র জঞ্জালের মতো পুড়িয়ে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এহেন রুচি ছিল তার! তার প্রেম হলো :কামগন্ধ নাহি তায়।
কিন্তু নারীদেহের সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন না, তার প্রশংসা করেননি, তা দিয়ে আকৃষ্ট হননি, তা নয়, অথবা প্রেমের সঙ্গে দেহের যোগাযোগ নেই_ এমন অসম্ভব কথাও তিনি বলেননি। একেবারে প্রথম যৌবনে লেখা 'শেষ চুম্বন', 'চুম্বন' এবং 'স্তনে'র মতো কবিতায় নারীদেহের প্রতি তার আকর্ষণ বলিষ্ঠ এবং স্পষ্টভাবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আরেকটু বেশি বয়সে লেখা 'বিজয়িনী'র মতো কবিতায় দৈহিক সৌন্দর্য কাটিয়ে তাকেও তিনি নৈর্ব্যক্তিক করে দেখেছেন। সৌন্দর্যের কাছে দেখতে পাই দেহের পরাজয়।
তিনি দেখতে ছিলেন খুবই সুদর্শন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রঙ ইউরোপীয়দের মতো, তার মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত একটি পরিবারের সদস্য। সবার ওপর, তার পরিচয়, তিনি কবি, গায়ক, লেখক, শিল্পী। সবকিছু মিলে তিনি কত নারীর হৃদয়ে ঢেউ তুলেছিলেন, আজ শত চেষ্টা করলেও তা আর জানা যাবে না।
যে বালিকার সঙ্গে তিনি প্রথমে প্রেমে পড়েন, তিনি তার অন্যতম বড় ভাই_ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী, কাদম্বরী দেবী। সেই বাল্য ও কৈশোরের প্রেমে অবশ্য কোনো দেহের যোগাযোগ ছিল না। এখন একুশ শতকের গোড়ায় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রেম সম্পর্কে যে দৈহিক অনুষঙ্গ তৈরি হয়েছে, সেই প্রেমের সঙ্গে তার প্রেমের কোনো মিলই ছিল না। কাদম্বরী দেবী ছিলেন তার প্রথম খেলার সাথি, এরপর সাহিত্যের পথপ্রদর্শক, বন্ধু, প্রথম পাঠিকা ও সমালোচক, তার পথের দিশারী। এমনকি একপর্যায়ে কৈশোরক প্রণয়ও তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল। একদিকে ব্যক্তিগত জীবনে কাদম্বরী দেবী ছিলেন 'গভীর দুখে দুখী'। তার বাবা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয় এবং কম বেতনের বাজার-সরকার। বেতন মাত্র কুড়ি টাকা। আগে থেকে তার সঙ্গে আত্মীয়তাও ছিল। তার মা ছিলেন স্বয়ং দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামাতো বোন। কিন্তু তাই বলে না আত্মীয়তার কারণে, না বৈবাহিক কারণে তিনি কোনো বিশেষ সম্মান পাননি ঠাকুর পরিবারের কাছ থেকে। কাদম্বরীর নিজের গায়ের রঙও ছিল শ্যামলা। সে তুলনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন রাজপুত্রের মতো।
পিতা বাজার-সরকার_ সেই সূত্রে কাদম্বরী বড় হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির নিচের তলার সাধারণ চাকরবাকরদের সঙ্গে, অযত্নে লালিত। ওপরতলার মূল পরিবারের সদস্যরা এদের দেখতেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে, কৃপার দৃষ্টিতে। এহেন নয় বছর বয়সী কালো মেয়েকেই বিয়ে করতে বাধ্য হলেন উনিশ বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বধূ হিসেবে মেনে নিলেন অন্য বউয়েরাও। কারণ, দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ অথবা আদেশ সে বাড়িতে ছিল বেদবাক্যের মতো। অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু অন্য বউয়েরা তাকে কখনও নিজেদের জা হিসেবে মন থেকে গ্রহণ করেননি। সবচেয়ে বিরোধিতা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী_ যিনি ছিলেন বিলেতফেরত এবং ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম সিভিলিয়ানের স্ত্রী। অতি আধুনিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওদিকে ভক্ত ছিলেন এই আধুনিকার। ভক্ত না বলে মোহগ্রস্ত বলাই ভালো। নিজের বউয়ের দিকে খানিকটা মনোযোগ দিয়েছিলেন কাদম্বরী যখন উদ্ভিন্নযৌবন। স্বল্প সময়ের জন্য। নয়তো বাড়িতে ফিরতেন না। কাদম্বরীর সঙ্গে দৈহিক মিলনও হতো না। অথবা হলে হতো ব্যতিক্রম হিসেবে। তাকে বন্ধ্যা বলে আখ্যায়িত করা হতো_ কোনো ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে তিনি যে গৃহের দিকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না_ এ জন্য সবাই বউয়েরই দোষ দিতেন, বিশেষ করে মহিলারা_ কারণ পুরুষের সাত খুন মাফ। কাদম্বরীর নিঃসঙ্গতা, হতাশা, রবীন্দ্রনির্ভরতা_ সবকিছুর কারণই এসব।
বিয়ের পর কাদম্বরীকে লেখাপড়া শিখিয়ে জ্যোতির উপযুক্ত করে তোলার সূচনা হয় তখন থেকেই। তিনি আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছিলেন খুবই কম। কিন্তু সে তুলনায় শিখেছিলেন অনেক বেশি। রীতিমতো সাহিত্যের সমঝদার হয়ে উঠেছিলেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্যে বড় হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। তিনি ছিলেন একটু বন্ধুত্ব, একটু ভালোবাসার কাঙাল। সেই একাকী, নিঃসঙ্গ কালো হরিণ চোখ মেয়েটি হঠাৎ বাইরের বাড়ি থেকে অন্তঃপুরে উপস্থিত হলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনও তাকে আগে দেখেছেন বলে জানা যায় না। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত, কাদম্বরীর থেকে এক বছর নয় মাসের ছোট। কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই স্নেহের প্রত্যাশী রবীন্দ্রনাথ এবং হীনমন্যতায় কাতর ও নিঃসঙ্গ কাদম্বরী দুজন দুজনের খেলার সাথি হয়ে উঠলেন। বালক রবি স্কুল থেকে ফিরেই তার ঘরে উপস্থিত হতেন। সেখানেই যত আবদার, যত খেলাধুলা, যত গল্প এবং স্বপ্নের জাল রচনা।
ধীরে ধীরে দু'জনই কৈশোরে পেঁৗছে গেলেন। তাদের বন্ধুত্বের চরিত্র খানিকটা বদলে যেতে আরম্ভ করল। সেই ভালোলাগা, ভালোবাসা নানা পর্যায়ে নানা রূপে প্রকাশ পেয়েছে। কাদম্বরী দেবীর_ আগেই বলেছি_ সাহিত্যে ছিল কৌতূহল। তিনি রবির সাহিত্য-সঙ্গিনীতে পরিণত হলেন। তার বিশেষ আগ্রহ ছিল কাব্যে, গানে, উপন্যাসে। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ার মাপে নয়, তিনি ছিলেন সত্যিকার সাহিত্য-রসিক। ভালোভাবে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে শিখেছিলেন। সেই রস গ্রহণের ক্ষমতাই তিনি সঞ্চারিত করে দিতে চেয়েছিলেন স্নেহের দেবরের মধ্যে। সাহিত্য-সঙ্গীত নিয়ে তারা একটি নিজেদের কুঞ্জ সাজিয়েছিলেন। সেখানে মাত্র একজন লেখক, পাঠকও একজনই। কাদম্বরী দেবী চাইতেন না, রবির লেখা সত্যিকার পরিণত হওয়ার আগেই, তা প্রকাশিত হোক, অন্য কেউ পড়ূক। এ শুধু তাদের দুজনার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের লেখা যতই পরিণত হতে আরম্ভ করল, তিনি ততই ব্যাকুল হয়ে উঠলেন আত্মপ্রকাশের জন্য। রবি আর একমাত্র কাদম্বরী দেবীর থাকলেন না। পাঠককুলের হয়ে উঠলেন।
ফলে, কাদম্বরী দেবী ক্রমাগত আবার নিঃসঙ্গ হতে থাকেন। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময় কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে প্রণয়ে।
প্রায় একই সময়ে একমাত্র খেলার সাথি আর বন্ধু সাড়ে সতেরো বছরের রবিকেও হারালেন। আনুষ্ঠানিক লেখাপড়ায় জুত হলো না, সুতরাং দেবেন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, তাকে বিলেতে পাঠাবেন। সম্ভব হলে মেজপুত্র সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করবেন। আর, তা না পারলে অন্তত ব্যারিস্টার হয়ে ফিরবেন। বিলেতের পথে আহমেদাবাদ যাত্রা করলেন ১৮৭৮ সালের মে মাসের দ্বিতীয় ভাগে। আহমেদাবাদে মাস তিনেক থেকে, আগস্ট মাসে গেলেন বোম্বাইয়ে। অতিথি হিসেবে থাকেন আত্মারাম পাণ্ডুরঙের পরিবারে। তিনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু।
সেখানে, কাদম্বরী ছাড়া, এই প্রথম তিনি কোনো নারীর সানি্নধ্যে এলেন। ইংরেজি ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজদের সংস্কৃতি এবং তাদের রীতিনীতি শেখার জন্য রবীন্দ্রনাথ সাত-আট সপ্তাহ থাকলেন বোম্বাইয়ের এই পরিবারে। আত্মারাম পাণ্ডুরঙের তিনটি মেয়ে ছিলেন, তিনজনই কেবল বিলেত ভ্রমণ করেননি, সেখানে লেখাপড়াও শিখেছেন। তাদের ছোটটির নাম আনা তরখড়। তারই ওপর দায়িত্ব পড়ল রবীন্দ্রনাথকে খানিকটা ইংরেজ করে তোলার। আনা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দু'বছরের বড়। কিন্তু অমন সুদর্শন কবি আর গায়কের প্রেমে পড়তে তার দেরি হয়নি মোটেই। রবীন্দ্রনাথও ইংরেজি শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরং কবিতা লিখে, গান রচনা করে, আনাকে 'নলিনী' নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন। মুগ্ধ করলেন এবং নিজের মনেও হয়তো রঙ লাগল। কিন্তু বাল্যকাল থেকে খেলার সাথি এবং এরপর একে অন্যের সঙ্গী হতে গিয়ে রবি আর কাদম্বরী বছর দশেক নিবিড় সানি্নধ্যে এসেছিলেন_ একেকটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নবনব রূপে পারস্পরিক সম্পর্কে সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসেছে। আনার সঙ্গে সে রকমের কোনো ঘনিষ্ঠতা হলো না। তবে 'নলিনী' যে তার হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও পরে তিনি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতটা গড়ে উঠেছিল, তা বলেছিলেন আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে [১.১.১৯২৭] :
আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই না ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে। এ কথা আমি মানব যে আমি টের পেতাম ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু হায় রে, সে হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনো রকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। ... একদিন সন্ধ্যাবেলা, ... সে আচমকা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত। চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া! কিন্তু আমি কেবলি ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছু। ... সে বলে বসল আহা কী ভাবো আকাশপাতাল। তার ধরনধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্ন করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ার খাটের উপরেই এসে বসল। ... আচ্ছা আমার হাত ধরে টানো তো_ টাগ অব ওয়ারে দেখি যে জেতে। ... শেষে একদিন বলল তেমনি আচমকা : জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার? বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সে চাইল তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করেনি। [প্রশান্ত পালের 'রবিজীবনী', দ্বিতীয় খণ্ডে উদ্ধৃত]
এ থেকেই বোঝা যায়, ভালোবাসাকে দৈহিক করে তোলার মতো স্থূল রুচি তার গড়ে ওঠেনি। তার বউদিকে তিনি তেমন করে ভালোবাসতেন বলেই মনে হয়। সাত বছর বয়স থেকে তার খেলার সাথি! সখী, বন্ধু।
আনার সঙ্গে ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়েছিল। পল্লবিত হয়নি। কিন্তু আনা অথবা রবীন্দ্রনাথ_ কেউই নলিনী নাম কখনো ভোলেননি। 'নলিনী' নামে গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। নাটক লিখেছেন। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মনে রেখেছেন। এ তো প্রেমই। আনাও যে তাকে ভালোবেসেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পরিবারের কাছে বিয়ের কথাও বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে চলে যান। এরপর দুজনের মধ্যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছিল কি-না, তার সঠিক খবর আমাদের জানা নেই।
এরপর রবীন্দ্রনাথ লন্ডন হয়ে যান ব্রাইটনে। তিনি মোটেই ভালো লাগাতে পারেননি নিয়ম আর পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগত কেবল ইংরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। ভর্তি হয়ে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কলেজের সামনের দিকের রাস্তায়, রিজেন্টস স্ট্রিটে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অতিথি হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করলেন ডাক্তার জন স্কটের বাড়িতে।
তিনি 'ইউরোপ-প্রবাসীর পত্রে' এ পরিবারের যে পরিচয় দিয়েছেন_ তা অনেকটাই বানানো। নামগুলো সবই বদলে দিয়েছেন। এ তথ্য জানা যায় ১৮৭১ আর ১৮৮১ সালের লোকগণনার প্রতিবেদন থেকে। সে বাড়িতে সার্জন জন স্কট ছাড়া আরও ছিলেন তার স্ত্রী, মেরী, তাদের তিরিশোর্ধ্ব কন্যা, সাতাশ বছর বয়সী মেয়ে ফ্যানি, আর পঁচিশ বছরের কন্যা লুসি। গৃহভৃত্য ছিল দু'জন। স্কট পরিবারে একটি পুত্রও ছিল রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল পরিবারের ছোট দুই মেয়ে_ ফ্যানি আর লুসির।
রবীন্দ্রনাথকে অমন সুদর্শন দেখে তার প্রেমে পড়তেও তাদের দেরি হলো না। বিশেষ করে লুসির। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিল তার চেয়ে ছয় বছরের বড় এই মেয়েটির প্রতি। লুসি তার কাছে বাংলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন আঠারো আনা। তাকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাংলা ভাষা ইংরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাংলা বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরং এর উচ্চারণ হলো : 'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ প্রথম সচেতন হলেন বাংলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাংলা ভাষার প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাংলা ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাংলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না।
লুসির আরেকটা অবদান_ তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইংরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান শিখিয়েছিলেন। এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে 'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন।
এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০ সালে তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো বাড়িতে ফিরে গেলেন।
১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবং তার পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষণ্ন হয়েছিলেন_ এ কথা তিনি নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই নিচের পঙ্ক্তিগুলোতে।
ফুরালো দুদিন
কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে_
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি
শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন
যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি
হৃদয়ে স্থাপিবে দিবে চির হাসি অশ্রু। বসন্ত বরষা_
তিনি দ্বিতীয়বার বিলেতে যান ১৮৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেবারে তিনি লিখেছিলেন ডায়েরি। তা থেকে জানা যায়, ১১ সেপ্টেম্বর তিনি যান তার বহু স্মৃতিবিজড়িত ডক্টর জন স্কটের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনলেন, স্কট পরিবার সেখানে আর থাকে না। তারা চলে গেছেন দক্ষিণ লন্ডনের উপকণ্ঠে নিউ মল্ডেনে। কবি তার তখনকার মনের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে_
ভারী নিরাশ হৃদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরলুম। মনে কল্পনা উদয় হলো, মৃত্যুর বহুকাল পরে আবার যেন পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। আমাদের সেই বাড়ির কাছে এসে দ্বারীকে জিজ্ঞাসা করলুম_ আমার সেই অমুক এখানে আছে তো? দ্বারী উত্তর করলো, না সে অনেক দিন হলো চলে গেছে! আমি মনে করেছিলুম কেবল আমিই চলে গিয়েছিলুম, পৃথিবীসুদ্ধ আর সবাই আছে। আমি চলে যাওয়ার পরেও সকলেই আপন আপন সময় অনুসারে চলে গেছে। তবে তো সেই সমস্ত জানা লোকেরা কেহ কারও ঠিকানা খুঁজে পাবে না। জগতের কোথাও তাদের আর নির্দিষ্ট মিলনের জায়গা রইলো না।... [প্রশান্ত পালের রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ডে উদ্ধৃত। পৃ. ১৫৫]।
স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে দেশে ফিরে আসার আগ মুহূর্তে বিষণ্ন হয়েছিলেন, কিন্তু লন্ডনে লেখাপড়া করার ব্যাপারে তার যে আগ্রহ তেমন ছিল না, আমরা আগেই তা লক্ষ্য করেছি।
মার্চ মাসে ফিরে আসার পর সবাই তাকে উষ্ণতার সঙ্গে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, দীর্ঘ বিরহের পর কাদম্বরী দেবী তাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়াই স্বাভাবিক। মে মাসে জ্যোতিদাদা আর বউদির সঙ্গে গেলেন বোলপুরে। কিন্তু ততদিনে তার দিগন্তটা একটু প্রসারিত হয়েছিল, তিনি আর একা কাদম্বরীর আদরের দেবর ছিলেন না। সে পরিবর্তন কাদম্বরী দেবী সম্ভবত অনুভব করতে পারলেন। করতে পেরে থাকলে তার আরও হতাশ এবং আরও নিঃসঙ্গ বোধ করার কথা। কিন্তু তাদের এ সময়ে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার তথ্যও জানা যায়। দুজনে মিলে ছাদের ওপরে তৈরি করলেন একটি বাগান_ 'নন্দনকানন'। সেখানেই সময় কাটত দুজনার। দুজন পরস্পরের বন্ধু, পরস্পরের ভালোবাসা এবং সান্ত্বনা। 'দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী'।
গঞ্জনা দেননি কেউ।
নতুন প্রেম দানা বাঁধছিল, স্থান বদলে যাওয়ার পরও সেই প্রেমঘন পরিবেশই বহাল থাকে_ অন্তত পরবর্তী দু'বছর। এবং এই সময়ে কাদম্বরী-রবীন্দ্রপ্রেম তার তুঙ্গে উঠেছিল।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিং বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে_ ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা 'ভারতী'তে প্রেমের উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে লেখেন : 'সেই জানলার ধারটি মনে পড়ে, সেই বাগানের গাছগুলি মনে পড়ে, সেই অশ্রুসিক্ত আমার প্রাণের ভাবগুলিকে মনে পড়ে। আর একজন আমার পাশে দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাকে মনে পড়ে, সে যে আমার খাতায় আমার কবিতার পাশর্ে্ব হিজিবিজি কাটিয়া দিয়াছিল সেইটে দেখিয়া আমার চোখে জল আসে। সেই ত যথার্থ কবিতা লিখিয়াছিল। তাহার সে অর্থপূর্ণ হিজিবিজি ছাপা হইল না, আমার রচিত গোটা কতক অর্থহীন হিজিবিজি ছাপা হইয়া গেল।'
এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথসহ গোটা ঠাকুরপরিবার সচকিত হয়ে উঠল। এর মাস ছয়েকের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন একটি নিরক্ষর গ্রাম্য মেয়েকে_ দক্ষিণডিহি থেকে [এখনকার খুলনার কাছে]। যাকে বিয়ে করলেন তার নাম ভবতারিণী। কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, দক্ষিণডিহির ধারেকাছে কোনো প্রাইমারি স্কুল ছিল না। সুতরাং তিনি স্কুলে যাননি অথবা কোনো পরীক্ষায় অংশ নেননি।
নিরক্ষর ছিলেন কি-না, সেটা নিয়ে বিতর্ক করলে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। তা সত্ত্বেও, 'আধুনিকা' জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নেতৃত্ব দিয়ে এই কন্যাকেই পছন্দ করে আনেন। কাদম্বরীকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করতেন, সেই কাদম্বরী-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের ওপর শোধ নেওয়ার জন্যই হয়তো ভবতারিণীকে বেছে নিয়ে এসেছিলেন। আর, কাদম্বরীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মেয়ে পছন্দ করার কাজে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান।
বিয়ের পর তাই তাকে একটা আধুনিক নাম দেওয়া হলো_ মৃণালিনী দেবী। তা ছাড়া, লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে তরুণ কবি ও গায়ক এবং অত্যন্ত সুর্দশন রবীন্দ্রনাথের 'উপযুক্ত' করে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে মেয়েমহলে। বিয়ের পরের মাসের হিসাবের খাতায় বর্ণপরিচয়, ধারাপাত, স্লেট ইত্যাদি কেনার তথ্য উল্লেখ করেছেন প্রশান্ত পাল।
ওদিকে কাদম্বরী দেবী আরও একবার নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবং অসহায় মনে করলেন। বিষণ্ন হলেন, যাকে এখন বলা হয় ডিপ্রেস্ড। তা সত্ত্বেও নিজেকে জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পরের সাড়ে চার মাস। এরপর ৮ বৈশাখ আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মারা যান পরের দিন রাতে অথবা তার পরের দিন সকালে। চিকিৎসাও করা হয়। আমার ধারণা, কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য। আর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে করার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই, এটা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি চিঠি থেকে কাদম্বরী এটা জানতে পারলেন যে, নটী বিনোদিনীর সঙ্গে তার স্বামীর প্রণয় সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা আগে থেকেই জানা ছিল, সুতরাং একে ঠুনকো অজুহাত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
কাদম্বরী দেবী মারা গেলেন, কিন্তু উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো তার প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা বেঁচে থাকল, যতদিন তিনি নিজে বেঁচে ছিলেন। কত গান, কত কবিতায় তার এই ভালোবাসা ভাস্বর হয়ে আছে। সেই সঙ্গে সোয়াশ' বছর পরে কাদম্বরী দেবী আজও অমর হয়ে আছেন রবীন্দ্র-সাহিত্যে আর সেই সঙ্গে অমর হয়ে আছে তাদের রোমান্টিক প্রেমের ক্লাসিক কাহিনী। রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা আর স্নেহের খিদে মিটিয়েছিলেন বউদি। বউদির অভাবে তার হৃদয় তৃষিত হয়ে উঠল। সেই ভালোবাসার অভাব মৃণালিনী দেবী পূরণ করতে পারলেন না। বস্তুত, মৃণালিনীর সঙ্গে তার এ সময়ে কোনো সম্পর্ক আদৌ গড়ে উঠেছিল কি-না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বন্ধু এবং সাহিত্যসঙ্গিনী হওয়া তো দূরের কথা। তবে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, বিয়ের দু'বছর পর পর্যন্ত মৃণালিনী দেবী লোরেটায় পড়ালেখা করেছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কা হয়েছিলেন। তার কিছু আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে খানিকটা ভালোবাসতে আরম্ভ করেন। দৈহিক দিক থেকেও খানিকটা আকৃষ্ট হন। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারিতে মৃণালিনী গর্ভবতী হন এবং অক্টোবরে তাদের প্রথম সন্তান বেলার জন্ম হয়।
মৃণালিনী দেবী আর ইন্দিরা দেবী একই বয়সের। কিন্তু লেখাপড়া আর মননশীলতায় তাদের ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল। কাদম্বরী দেবী মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরে রবীন্দ্রনাথ সেই ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লেখা আরম্ভ করলেন। প্রথমে স্নেহের কথা, নিজের অভিজ্ঞতার কথা। ১৮৮৭ সাল থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই তরুণী ইন্দিরাকে ২৫২টি চিঠি লিখেছেন। বিশেষ করে তিনি যখন জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরে যেতে আরম্ভ করেন। একই সময়ে তিনি মৃণালিনী দেবীকে চিঠি লেখেন মাত্র ১৫টি। তখন গ্রাম-বাংলার অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন, কখনও গান, আর কখনও ইন্দিরা দেবীকে দীর্ঘ চিঠিতে_ 'ছিন্নপত্রাবলী'তে যা এখনও অছিন্ন এবং অমলিন হয়ে আছে। অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে, 'ছিন্নপত্রাবলী'র চিঠিগুলো সম্পূর্ণ পাঠ নয়_ সম্পাদিত। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বর্জিত। কিন্তু ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিতে কেবল নিসর্গের সৌন্দর্য বর্ণনা আর স্নেহসম্ভাষণ ছিল না। রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের তথ্য এবং বিশ্লেষণ থেকে মনে হয়, ভালোবাসার অঙ্কুরও দেখা দিয়েছিল কবির হৃদয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন ইন্দিরার বয়স যখন উনিশ_ তখনকার একটি পত্র থেকে :
এসব শিষ্টাচার আর ভালো লাগে না_ আজকাল প্রায় বসে বসে আওড়াই_ ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন! বেশ একটা সুস্থ সবল উন্মুক্ত অসভ্যতা! বিচার আচার বিবেক বুদ্ধি নিয়ে কতকগুলো বহুকেলে জীর্ণতার মধ্যে শরীর মনকে অকালে জরাগ্রস্ত না করে দ্বিধাহীন চিন্তাহীন প্রাণ নিয়ে খুব একটা প্রবল জীবনের আনন্দ লাভ করি। মনের সমস্ত বাসনা ভাবনা, ভালোই হোক মন্দই হোক, বেশ অসংশয় অসঙ্কোচ এবং প্রশস্ত_ প্রথার সঙ্গে বুদ্ধির, বুদ্ধির সঙ্গে ইচ্ছার, ইচ্ছার সঙ্গে কাজের কোনো রকম অহর্নিশ খিটিমিটি নেই। একবার যদি রুদ্ধ জীবনকে খুব উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলভাবে ছাড়া দিতে পারতুম, একবার দিগ্বিদিকে ঢেউ খেলিয়ে ঝড় বাধিয়ে দিতুম, একটা বলিষ্ঠ বুনো ঘোড়ার মতো কেবল আপনার লঘুত্বের আনন্দ আবেগে ছুটে যেতুম! কিন্তু আমি বেদুইন নই, বাঙালি। আমি কোণে বসে বসে খুঁতখুঁত করব, বিচার করব, তর্ক করব, মনটাকে নিয়ে একবার ওল্টাব একবার পাল্টাব_ যেমন করে মাছ ভাজে ফুটন্ত তেলে, একবার এ পিঠ চিড়বিড় করে উঠবে, একবার ও পিঠ চিড়বিড় করবে। যাক গে, যখন রীতিমতো অসভ্য হওয়া অসাধ্য তখন রীতিমতো সভ্য হবার চেষ্টা করাই সঙ্গত।
এই চিঠির অন্তর্নিহিত ভাষা এবং ইঙ্গিত খুবই অসাধারণ। এ সময়কার আঁকা কবির একটি হেঁয়ালি-চিত্রও ইঙ্গিতবহ। প্রশান্ত পালের 'রবিজীবনী'র তৃতীয় খণ্ডের ৬৪ এবং ৬৫ পৃষ্ঠার মাঝখানে এই চিত্রটি মুদ্রিত হয়েছে। এই চিত্রগুলোর প্রথমটি হলো বি অর্থাৎ বিবি। দ্বিতীয় চিত্রটির সমাধান হলো : ইন্দিরা। পৃষ্ঠার একেবারে শেষ চিত্রটির সমাধান প্রণয়। এই চিত্রের মধ্য দিয়ে কবির সচেতন অথবা অবচেতন মনের কোনো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কি-না, সেটা গুরত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
ইন্দিরার বয়স ছাবি্বশ, সাতাশ হয়ে যাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের কথাও সূচনা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, চিঠিগুলোয় আরও আনুষ্ঠানিকতা দেখা যাচ্ছে। ১৮৯৯ সালে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ের পর চিঠির ভাষা এবং সম্ভাষণ_ দুই-ই পাল্টে গেল। এমনকি চিঠি লেখার ধারাও গেল শুকিয়ে।
এর অল্পদিন পরেই মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন। মৃণালিনী দেবী মারা যাওয়ায় তিনি ব্যথা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতি কবির প্রণয় যে গভীর ছিল, মনে হয় না। বিশেষ করে তিনি তাকে চৌদ্দ-পনেরোটি চিঠি লিখেছিলেন, তার মধ্যে কোনো কোনো চিঠিকে বেশ নির্দয় বলেই মনে হতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর রোমান্টিক প্রণয় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। চিঠিপত্রে কাজের কথা যত থাকে, তার থেকে মনের আবেগ-অনুভূতির কথা কমই থাকে। এ কথা মনে রাখলেও, মৃণালিনীকে লেখা নিচের চিঠিটি অসাধারণ বলতে হবে।
যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভালমান্ষির কাল নয়। কাকুতিমিনতি করলেই অমনি নিজ মূর্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একেবারে জল। একেই তো বলে বাঙাল। ছি, ছি, ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙাল করে তুল্লে গা!
সংক্ষেপে বলা যায় : এই ছিল মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে কবির সম্পর্কের আসল চেহারা। মৃণালিনী মারা যাওয়ার পর_ তার অভাব নিশ্চয় অনুভব করে থাকবেন। মাতৃহীন সন্তানদের বাড়তি দায়িত্বও পড়েছিল তার কাঁধে। কিন্তু তার স্মৃতি তাকে ব্যাকুল করত এমনটা ভাবা মুশকিল। আর মৃণালিনী যখন মারা যান, তখন তার বয়স সাতাশ, আর কবির বয়স মাত্র ৪০। দেহের চাহিদার সঙ্গে অন্তরের খিদেয় কখনও কখনও নিশ্চয় ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। কিন্তু কার অথবা কাদের জন্য, তা জানা যায় না। কিন্তু অতি সুদর্শন কবি ও গায়ক রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিশ্চয় বহু নারীই আকৃষ্ট হয়েছে। তিনি নিজেও কি আকৃষ্ট হননি বহু নারীর দিকে? বয়স যখন সত্তরের কোঠায়, তখন পেছনের দিকে তাকিয়ে তিনি লিখেছিলেন, 'শুধায়ো না, কবে কোন গান/কাহারে করিয়াছিনু দান।'
এর বছর তিনেক পরে তার ৫৭ বছর বয়সে একটি তরুণী উদিত হন তার জীবনে_ যার নাম রানু অধিকারী। কাশীবাসী এক অধ্যাপকের উদ্ভিন্নযৌবনা সুন্দরী কন্যা। ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তার কাছে রবীন্দ্রনাথের দেবত্ব ছিল অর্থহীন। সবাই গুরুদেব বলে সম্মান জানালেও তিনি সম্মানের দূরত্ব রাখেননি। নিজের থেকে ৪২ বছরের বেশি বয়সী এক জগদ্বিখ্যাত বুড়োর বন্ধুতে পরিণত করেন। তার চিঠিপত্রের মধ্যে নিজের ভালো লাগাটাকে লাগাম দিয়ে থামিয়ে দিতে চাননি।
ষোলো বছর বয়সে রানু যখন শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে কবিকে ছাড়লেন, তখন কবির মনে হয়েছিল তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তার সে সময়কার অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ পেয়েছে কেবল তখনকার গান আর কবিতা থেকে। এর বহু বছর পরেও তার কথা মনে রেখে, তিনি গান লিখেছেন : 'ওগো তুমি পঞ্চদশী, পেঁৗছিলে পূর্ণিমাতে।'
এর কয়েক বছর পর রবীন্দ্রনাথের জানা প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল আরও একটি। তখন তার বয়স ৬৩ বছর। আর যার প্রেমে পড়েন তিনি এক বিদেশিনী, বয়স ৩৪। কবির পরিকল্পনা ছিল ব্রাজিল হয়ে চিলিতে যাওয়ার। কিন্তু দৈবক্রমে জাহাজে তিনি দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই ব্রাজিল যাওয়া মাত্র হলো, দেখা হলো না সেভাবে। কদিনের মধ্যে অসুস্থ অবস্থাতেই গেলেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আইরিসে। প্রথমেই সেখানে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমনকি অন্য ক'টি দেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই পরিবেশে হোটেল থেকে নদীর ধারের একটি বাড়িতে গিয়ে তাকে আন্তরিকতা দিয়ে সেবা করেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (১৮৯০-১৯৭০)। ১৯১৪ সালে অনুবাদে 'গীতাঞ্জলি' পড়ার পর থেকে তার কৌতূহল জাগে রবীন্দ্রনাথের প্রতি। মনে মনে কবিকে ভালোবেসে ফেলেন তিনি। তিনি সেই কবিকে পেয়ে অত্যন্ত মুগ্ধ হন।
তার বয়স তখন ৩৪। বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু আট বছরের চেয়ে বেশি টেকেনি। তার একাধিক বন্ধুও জুটেছে। কিন্তু সেভাবে কোথাও বাসা বাঁধেননি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ২৯ বছরের ছোট। তাকে দেখে তার ঘনিষ্ঠতা লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বহু বছর পরে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন যে, তিনি তার নৈকট্য চেয়েছিলেন। অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। সমাজের ওপরতলায় তার অবাধ বিচরণ। একটি বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকার সম্পাদক। বহু গ্রন্থের লেখিকা। বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করার নেশাও ছিল তার।
অপরপক্ষে স্নেহ ও ভালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার রূপে, গুণে, সেবাযত্ন আর ব্যক্তিত্বে অচিরেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রায় চলি্লশ বছর আগে আনা তরখড়কে বাংলা নাম দিয়েছিলেন নলিনী। এবারে ভিক্টোরিয়া শব্দের কথা মনে রেখে তার নাম দিলেন 'বিজয়া'।
ভিক্টোরিয়া প্রথমে নদীর ধারের যে বাড়িতে রেখেছিলেন, সেখানে কবির সেবাযত্ন করত ভৃত্যরা। সেই সেবাযত্নের অনেকটাই তিনি তুলে নিলেন নিজের হাতে। কবি বিজয়াকে নিয়ে কবিতা লিখতে আরম্ভ করলেন। এগারো নভেম্বর নতুন প্রেমের আভাস পেয়েই বোধহয় বউদির সঙ্গে কৈশোরক প্রণয়ের কথা মনে পড়ে। পরের দিন 'বিদেশী ফুলের' প্রতি তার কৌতূহল প্রকাশ করেন। পনেরোই নভেম্বর লিখলেন :
প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী,
মাধুর্যের সুধায়; কত সহজে করিলে আপনারি
দূরদেশী পথিকেরে; যেমন সহজে সন্ধ্যাকাশে
আমার অজানা তারা স্বর্গ হতে স্থির সি্নগ্ধ হাসে
আমারে করিল অভ্যর্থনা
বুয়েন্স আইরিসে থাকার কথা ছিল মাত্র ক'দিনের। কিন্তু স্বাস্থ্য খারাপ থাকায় ডাক্তার তাকে চিলি-সফর বাতিল করার পরামর্শ দিলেন। ভেবেছিলেন, চিলি থেকে শান্তিনিকেতনের জন্য কিছু টাকা জোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু সে আশা বিসর্জন দিয়ে দু'মাস থাকলেন সেখানে। আমার ধারণা, সেখানে থাকার আরেকটা প্রধান আকর্ষণ ছিলেন ভিক্টোরিয়া।
কবির সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য ২৯ বছরের। কিন্তু ভিক্টোরিয়া ৬৩ বছর বয়স্ক কবির কপালে একটিও রেখা দেখতে পাননি। অপরপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার বয়স নিয়ে ভাবেনওনি। দেখেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। ভিক্টোরিয়া কবির নৈকট্য ['নিয়ারনেস'] কামনা করেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্ক বিষয়ে আগের মতোই কোথাও কিছু লেখেননি। তবে কবিতায়, গানে তার ভালোবাসাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি, নিজের মনের মতো। যেমনটা পেরেছিলেন আনুষ্ঠানিকতায় পূর্ণ বক্তব্য এবং আচরণে। মুখে তিনি যা-ই বলে থাকুন না কেন, ভিক্টোরিয়ার সঙ্গ তিনি খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কেউ সে অর্থে কারও মন বুঝলেন না, হয়তো দুই ব্যক্তি বলেই নয়, দুই সংস্কৃতিও তার পেছনে কাজ করে থাকবে। ভিক্টোরিয়া নিজেই কবিকে লিখেছেন, 'এই সানি্নধ্যের সময়ে, আমি আপনার নৈকট্য পেয়ে আনন্দিত ছিলাম, আর আপনি যে আমার সানি্নধ্যকে ঠেকিয়ে রেখেছেন দূরে, এই বেদনায় আমি কষ্ট পেয়েছি।' ভিক্টোরিয়া সম্ভত কবির মন এবং দেহ_ উভয় প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে এ ব্যাপারে যে রুচি কাজ করেছিল, তা-ই ভিক্টোরিয়াকে তার আরও কাছে আসতে দেয়নি_ 'কাছে থেকে দূর রচিলো, কেন যে আঁধারে।'
৬৫ বছরের তার প্রণয়-জীবনের দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছিলেন, তার মধ্যে এক ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়। প্রথম জীবনে যে চার নারীকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তাদের সবার বয়সই, তার চেয়ে বেশি। ছেলেবেলায় তার যে মাতৃস্নেহের খিদে মেটেনি, সেই ঘাটতি হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন এসব নারীর ভালোবাসায়।
কিন্তু কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করার পর থেকে তার সেই প্রেমের চরিত্র পালটে যেতে আরম্ভ করে। বউদির মৃত্যুতে যে ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দেয়, তা পূরণের চেষ্টা করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক অশিক্ষিত গ্রাম্য স্ত্রী ভবতারিণী আর একই বয়সী সুন্দরী, বিদুষী, বহু ভাষাভাষী, বিলেত ফেরত স্মার্ট ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার অপরিণত ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তার প্রথম যৌবনে আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তান লাভ ছাড়া, নিঃসঙ্গতা অথবা সত্যিকার ভালোবাসার স্বাদ মিটেছিল বলে মনে করা শক্ত। বিশেষ করে যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ তাকে যেসব চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তা থেকে।
অপরপক্ষে, ইন্দিরা যেন 'কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন'। রবীন্দ্রনাথ তার ঘুম ভাঙান। প্রেম নিবেদন করতে পারেননি সরাসরি, কিন্তু তার কাছে লেখা ২৫২টি চিঠিতে তিনি যেমন করে তার মনের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন, এমন কারও কাছে দেননি। তার মধ্য দিয়েই জানা যায়, প্রেমের ব্যাপারে, তার মনের গহিনে কী দ্বন্দ্ব চলেছিল প্রবৃত্তির সঙ্গে বিবেকের। সমাজ ও রীতিনীতির সঙ্গে স্বাভাবিক প্রণয়ের লড়াই চলেছিল। কখনও নিয়ম-নীতিকে ভেঙে তছনছ করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার উদ্দাম প্রণয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। এখানে আরও লক্ষ্য করার বিষয় : এ পর্যায়ে তার প্রণয় স্বপ্নের সীমানা নিকটাত্মীয়দের ঘিরেই। এ সীমানা পেরিয়ে তিনি পা বাড়াননি। সেই সীমানার মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছেন, নিজেকেই নিজে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। আত্মধিক্কারে তিনি কখনও কখনও আত্মহত্যা করার মতো কঠোর পথ বেছে নেওয়ার কথা ভেবে দেখেছেন।
এই সমীনার বাইরে তাকে এক নন্দিনী এসে টেনে বের করলেন। হাতে তার রক্তকরবীর গুচ্ছ ছিল কি-না, তা জানা নেই। কিন্তু রাজাকে তিনি মুক্তি দিলেন তার সীমানা থেকে। রানুর থেকে ভানুর বয়স ছিল ৪২ বছর বেশি। কিন্তু এই উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরী তাকে মুগ্ধ করেছিলেন তার দৈহিক সৌন্দর্য আর ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গেও বয়সের পার্থক্য ছিল ২৯ বছর। দক্ষিণ আমেরিকার তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত নারী_ মননে আর ফ্যাশনে। তিনি রবীন্দ্রনাথের নৈকট্য চেয়েছিলেন_ দেহ ও মন_ উভয়ের। কোনো বাধা ছিল না_ আত্মীয়তার অথবা দেশীয় রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধের। কিন্তু বাধা ছিল একেবারে অন্তর্গত। রবীন্দ্রনাথের আজন্মলালিত ভিক্টোরীয়-ব্রাহ্ম রক্ষণশীল শুচিবায়ুগ্রস্ত রুচি তাকে অর্গলমুক্ত সাধারণ মানুষের মতো হতে দেয়নি। আলিঙ্গন চেয়েছেন, নিবিড় আলিঙ্গন। কিন্তু প্রিয়ার দেহকে তিনি ভরে দিতে চেয়েছেন অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বৈশিষ্ট্য।

[সংক্ষেপিত]

সমকাল | তারিখ: মে ৭, ২০১১