Thursday, August 23, 2012

বঙ্গবন্ধু কেন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন?

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র চার দিনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বাংলাদেশের তারিখ বইয়ে এ রকম একটি চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ দেখে আমরা অনুসন্ধান চালাই।
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর কী ধারণার ভিত্তিতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। কারণ, সেদিন যে নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল, আগামী বছরেই শেখ হাসিনার হাতে তারই পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে, বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ বহাল রেখে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাতে এ বিষয়টি পর্যালোচনা করা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের রাত ১২টা ১ মিনিটে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল গণপরিষদ। এর সমাপ্তি অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্বের বুকে তাঁরা একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের তখনকার অনেকের কাছে জানতে চাইলাম, সাধারণ নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী মুজিব কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা মন্তব্য করেননি। এমনকি অনেকে স্মরণও করতে পারেননি যে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল।
সংসদীয় রীতি হচ্ছে, কোনো প্রধানমন্ত্রী আস্থা ভোটে পরাস্ত হলে পদত্যাগ করবেন। মধ্যবর্তী নির্বাচন দিলে তিনি শুধু সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে না। তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে। কিন্তু তিনি তাঁর উত্তরসূরি না আসা পর্যন্ত স্বপদে আপনাআপনি টিকে থাকবেন।
১৯৭২ সালে গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের জন্য নয়। কারণ, গণপরিষদের একমাত্র ম্যান্ডেট ছিল সংবিধান প্রণয়ন। নতুন সংবিধান কার্যকর করার প্রয়োজনেও গণপরিষদ ভাঙা হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো কার্যকরী গণপরিষদ বা সংসদ ছিল না। ৭ মার্চে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল।
কিন্তু সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভের পর মাত্র চার দিনের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল না।
ভারতে ২০০৯ সালের ১৬ এপ্রিল থেকে ১৩ মে লোকসভা নির্বাচন হলো। এর পাঁচ দিন পরে ১৮ মে সকালে ভারতের মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকার রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলকে চতুর্দশ লোকসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেবে। ওই দিনই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পেশ করেন। রাষ্ট্রপতি নতুন সরকার গঠন পর্যন্ত বিদায়ী মন্ত্রিসভাকে দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ জানান। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু হয়তো এই রীতিটি অনুসরণ করেছিলেন।
বর্তমানে বড় বিতর্ক দেখা দিয়েছে যে সংসদ রেখে আরেকটি সংসদ সৃষ্টি করা যাবে কি না। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, ড. শাহ্দীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল প্রমুখ এই বিধানের সমালোচনা করছেন। ড. কামাল হোসেনও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার ক উপদফা অবশ্য সংসদ না ভেঙে সংসদ গড়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। ১৯৭২ সালে সংবিধানে এই বিধান সংযোজনের পর এটি প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭৫ সালে সংসদ ভেঙে গেল। এরপর সংসদ নির্বাচন হলো ১৯৭৯ সালে। সেই সংসদ মেয়াদ পুরা করার আগেই ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ভেঙে গেল। এরপর জেনারেল এরশাদের ১৯৮৬ সালের ৭ মে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে গেল। ১৯৮৮ সালের সংসদের পাট ১৯৯০ সালেই চুকল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত ষষ্ঠ সংসদ মার্চে ভেঙে যায়। সপ্তম সংসদ থেকে ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় সংসদ নির্বাচন সংসদ না থাকা অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৯১ সালে সংবিধান সংস্কারের বিরাট সুযোগ এসেছিল। সেদিন রাজনীতিবিদেরা সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতির ঐতিহ্যবাহী এখতিয়ারকে বিনা আলোচনায় ছুরিকাহত করেছিলেন। দ্বাদশ সংশোধনীতে তাঁরা লিখেছিলেন যে রাষ্ট্রপতি শুধু প্রধানমন্ত্রীর ‘লিখিত’ পরামর্শে সংসদ ভাঙবেন। বাহাত্তরের সংবিধানে এটা ছিল না। অন্যান্য সংবিধানেও দেখি না। এই ‘লিখিত’ শব্দটি সংযোজন করে বিএনপি কার্যত সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপর একটা হামলা চালিয়েছিল। কেন এটা হামলা, তা পরে বলব। তবে আওয়ামী লীগের তা খুব মনঃপূত হয়েছিল। ১৫তম সংশোধনীতেও তারা ওই ‘লিখিত’ কথাটি সযত্নে রেখে দিয়েছে। এরা যে বহু ক্ষেত্রে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, তা আমরা এমনসব কাণ্ডকীর্তি থেকে প্রমাণ পাই। আজকের বিএনপি সংসদ রেখে সংসদ নির্বাচন করাসংক্রান্ত যে বিধানের জন্য আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করছে, সেটা কিন্তু তারাই ১৯৯১ সালে বাহাত্তরের সংবিধান থেকে টুকলিফাই করেছিল। বিএনপি এখন এমন ভাব নিচ্ছে যে সংবিধান কাটাছেঁড়াসংক্রান্ত যত দোষ আওয়ামী লীগই তা করেছে।
১৯৭৩ সালে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটা আমাদের বিস্তারিত জানা দরকার। ১৩ মার্চ ১৯৭৩। মঙ্গলবার। ইত্তেফাক পত্রিকার শীর্ষ শিরোনাম ছিল, ‘বর্তমান মন্ত্রিসভা চার দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুক্রবার নয়া মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ।’ এই খবরে বলা হয়, ‘১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে কাজ করে যেতে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মুজিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এবং প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।’
এখানে বলা দরকার যে ইত্তেফাক-এর ওই প্রতিবেদনটি ভ্রান্তিকর ছিল। কারণ, তারা লিখেছিল, ‘বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ইচ্ছানুযায়ী বিদায়ী সরকার “কেয়ারটেকার সরকার” হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিধানও সংবিধানে আছে।’ অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে এ রকম কথা লেখা ছিল না। তবে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা অস্বাভাবিক ছিল না। দৈনিক আজাদ এনা পরিবেশিত খবরের শিরোনাম দিয়েছিল, ‘মন্ত্রিসভার পদত্যাগ, রাষ্ট্রপতির অনুরোধে বঙ্গবন্ধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ চালাবেন’। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদের কাছে জানতে চাইলে ১১ আগস্ট লেখককে তিনি বলেন, ‘আমি যে পদত্যাগ করার দিনটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম, সেটা স্মরণ করতে পারি। হয়তো তিনি চেয়েছিলেন যে যেহেতু নির্বাচনে তিনি জিতেছেন, এখন সরকার গঠন করতে হবে। ওই চার দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়েছিল। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এবং সেই হিসেবে তিনি সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।’
আমরা লক্ষ করি যে বিরোধী দল তখনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তুলেছিল। ১৯৭৩ সালের ৬ জানুয়ারি আতাউর রহমান খান নির্বাচনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’ অবশ্য তিনিও যে অতিরঞ্জন করতেন তার প্রমাণ হলো, তিনি বলেছিলেন, ‘১০ ভাগ লোকও ভোট দিতে আসবেন না।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. ইদ্রিসকে আশ্বস্ত করতে হয়েছিল যে ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে। কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হবে না। ন্যায়নীতি, সততা বজায় থাকবে।’ নামে মাত্র থাকা তখনকার বিরোধী দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতির মন্তব্য নিয়ে আজাদ-এর একটি শিরোনাম ছিল, ‘তথাকথিত বিরোধী দলরা স্বাধীনতা নস্যাতের ষড়যন্ত্র করছে: জিল্লুর’।
যাহোক, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে আগামী বছর আরেকটি সংসদ নির্বাচন করার উদ্যোগ প্রসঙ্গে আসি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিকে বলেছেন, ‘মেয়াদ অবসানের ৯০ দিন আগে তো সংসদের কোনো অধিবেশন বসছে না।’
বঙ্গবন্ধু হয়তো তেমন কোনো বিতর্ক ছাড়াই নির্বাচন পর্যন্ত গণপরিষদ টিকিয়ে রাখতে পারতেন। তিয়াত্তরের নির্বাচনের কয়েক দিন পরে তিনি সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, ‘তাঁরা চাইলে নির্বাচন ছাড়াই আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকতে পারতেন।’ কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে আমরা স্মরণ করব যে তিনি গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। সুতরাং, মুজিবের জমানায় সংসদ সদস্য হিসেবে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হননি। ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর অপরাহে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে নতুন সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী মুজিবসহ মন্ত্রিপরিষদ ও প্রধান বিচারপতি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের সমাপ্তি টেনে বলেছিলেন, ‘আপনারা এমসিএগণ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে বিশ্বের ইতিহাসে একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর হতে আর কেউ এমসিএ হিসেবে পরিচিত হবেন না। এবং গণপরিষদও স্বাভাবিকভাবে ভেঙে যাবে। (আজাদ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২) এদিন ইত্তেফাক-এর রিপোর্ট ছিল, ‘আমরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। পুনরায় ফিরে যাব নতুন ম্যান্ডেটের জন্য।’
নতুন ম্যান্ডেটের জন্য বর্তমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা সংবিধানের বর্তমান বিধানের অধীনেও সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের দাবি না মেনে এবং নিজে পদত্যাগ না করেও সংসদ ভেঙে দিতে রাষ্ট্রপতিকে লিখিত পরামর্শ দিতে পারেন। এর ফলে তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো বলতে পারবেন যে ‘আমরা নতুন ম্যান্ডেট পেতে সংসদ ভেঙে দিয়েছি।’
আমরা বিশ্বের বহু সংবিধান মিলিয়ে দেখেছি। সংসদ রেখে সংসদ তৈরি করার বিধানসংবলিত ১২৩ অনুচ্ছেদের ৩ দফার মতো কোনো দফা নজরে এল না। ভারতের সংবিধানেও এ রকম দফা নেই। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানেও ছিল না। তবে লোকসভা রেখে লোকসভা করার বিধান আছে ভারতের নির্বাচনী আইনে।
বাংলাদেশ সংবিধানে কী করে এটা এল? বিষয়টি ড. কামাল হোসেনের নজরে নিয়েছিলাম। তিনি মন্তব্য করেননি। আমি এত দিন টিভি টক শোতে বলে আসছিলাম, এটা বুঝি বাহাত্তরের সংবিধানে অসাবধানতায় ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে আলাপ করে আমি হতবাক। তিনি বললেন, আমিই এই অনুচ্ছেদটির রূপকার। অনেক ভেবেচিন্তেই আমরা এটা সংবিধানে যুক্ত করেছিলাম।
আগামীকাল: সংসদ রেখে সংসদ তৈরির ভ্রান্তি
 মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক। তারিখ: ২৪-০৮-২০১২ | প্রথম আলো
mrkhanbd@gmail.com

Saturday, August 11, 2012

ফেসবুকের ছায়াবন্ধু, নাকি সামনের কায়াবন্ধু!

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমাকে একট গল্প শুনিয়েছেন। গল্প নয়, সত্য ঘটনা। চীনের এক দম্পতি কম্পিউটারে এক নতুন খেলা পেয়েছেন। একটা বাচ্চাকে লালন-পালন করতে হয়। তাঁরা সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকেন। এই বাচ্চাকে খাওয়ান, পরান, গোসল করান। এই বাচ্চার প্রতি তাঁদের যত্নের সীমা নেই। তাঁরা একেবারেই মগ্ন হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের একটা বাচ্চা ছিল। খেলায় মগ্ন এই দম্পতি নিজেদের বাচ্চার কথা ভুলে গেলেন। একদিন দেখা গেল, বাচ্চাটা মরে পড়ে রয়েছে।

২.
জ্যাক দেরিদা রুশোর স্বীকারোক্তিমূলক আত্মজীবনী কনফেশনস থেকে উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতীক বা বিকল্প কখনো কখনো নিজেই প্রধান হয়ে ওঠে। রুশো কৈশোরে যে বাড়িতে থাকতেন, সেই গৃহকর্ত্রীকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সেই ম্যাডাম যে বিছানায় শুতেন, রুশো সেই বিছানাকে চুমু দিতেন, আদর করতেন তাঁর চেয়ারকে, মেঝেকে, পর্দাকে। কারণ, ওসব ছিল তাঁর ম্যাডামের বিকল্প। সামনে ম্যাডাম নেই, কিন্তু এসব বস্তুর মাধ্যমে রুশো তাঁর ম্যাডামের অভাব পূরণ করছেন। কিন্তু একদিন ম্যাডাম তাঁর সামনে, খাচ্ছেন। রুশো বললেন, খাবারে একটা চুল। ম্যাডাম খাবারটা মুখ থেকে বের করতেই রুশো সেই খাবার নিজের মুখে পুরলেন।
এখানে তো ম্যাডাম সামনে আছে, তাহলে কেন রুশো ম্যাডামের মুখের খাবার মুখে পুরলেন।
ম্যাডাম, যাঁকে রুশো বলতেন ম্যামান, তিনি ছিলেন রুশোর মায়ের বিকল্প। তারপর মায়ের চেয়ে ম্যাডামই মুখ্য হয়ে উঠলেন। তারপর ম্যাডামের চেয়ে বিভিন্ন বিকল্পই মুখ্য হয়ে উঠল।
দেরিদা দেখিয়েছেন, এভাবে বিকল্পই প্রধান হয়ে ওঠে।
দেরিদার বক্তব্য হলো, লেখা মুখের কথার বিকল্প নয়, পরিপূরক নয়, লেখাই আসল। টেক্সটই আসল। আমরা কি সেই যুগে প্রবেশ করলাম, যেখানে বাস্তবের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে ভারচুয়াল বাস্তবতা, যেখানে রক্ত-মাংসের বন্ধুর চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে স্ক্রিনে দেখা (ও পড়া) ছায়াবন্ধুটি?
সুমনা শারমীন লিখেছিলেন, মা পাশের ঘরে অসুস্থ পড়ে আছেন দিন সাতেক ধরে, ছেলে একবারও তাঁকে দেখতে যায়নি, কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে, প্রে ফর মাই মাদার, শি ইজ সিক। মাদার, গেট ওয়েল সুন।

৩.
প্রযুক্তি, যোগাযোগের বিকল্প মাধ্যমগুলো আমাদের কাছে জ্যান্ত মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কি না?
আমার সামনে আমার বন্ধু বসে আছেন, মা বসে আছেন, বাবা বসে আছেন, ডাক্তার বসে আছেন, এই সময় মোবাইল ফোন বেজে উঠল। আমরা সেটা আগে ধরাটাকেই কর্তব্য বলে মনে করি।
আমার জলজ্যান্ত বন্ধু সামনে বসে আছে, কিন্তু তাকে রেখে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই, আমি এখন বন্ধুর সঙ্গে কফি খাচ্ছি।
পাঁচজন স্কুলবন্ধু, তাঁদের দেখা হলো আজ ২২ বছর পরে, তাঁরা আজ একটা জায়গায় একত্র হচ্ছেন, কী ভীষণ উত্তেজনা তাঁদের মধ্যে। দেখা হওয়ার পরে পাঁচজনই পাঁচটা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কেউ ফেসবুক করছেন, কেউ বা গেমস খেলছেন, কেউ বা খুদেবার্তা পাঠাচ্ছেন, কেউ বা জরুরি ই-মেইল সেরে নিচ্ছেন, কেউ বা চ্যাট করছেন দূরবর্তী কারও সঙ্গে।
সামনে সমুদ্র, একটু পরে অস্ত যাবে সূর্য, সেদিকে খেয়াল নেই। আমি স্ট্যাটাস দিচ্ছি, আহ্, লাইফ ইজ বিউটিফুল, আই অ্যাম ইন আ প্যারাডাইস।
প্রেমিক দেখা করতে গেছে প্রেমিকার সঙ্গে, কোনো নির্জন জায়গায়। দুজনের হাতে দুটো মোবাইল ফোন, দুজনেই নিজ নিজ ফোন নিয়ে ব্যস্ত, সারাক্ষণ বুড়ো আঙুল চলছে।
আমি মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালাতে চালাতে একজন পথিককে এসএমএস করতে দেখেছি।
আমি বিয়ের আসরে বসা বরকে এবং বউকে দেখেছি, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।

৪.
একটা কৌতুক ছিল। একজন সম্ভাব্য পাত্র ঘটককে বলল, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই, যে কিনা আমাকে আমার ইচ্ছামতো বিনোদন দেবে, আমি চাইলে সে কথা বলা বন্ধ করবে, চাইলেই গান গাইবে, বা নাচবে, বা কথা বলবে, আবার আমি যখন চাইব তখনই সে ঘুমিয়ে পড়বে, আমি চাইলেই সে অন হবে, আমি চাইলেই সে অফ হবে।
ঘটক বললেন, ভাই, আপনি একটা টেলিভিশনকে বিয়ে করুন।
এই কৌতুককে আধুনিকায়ন করে বলা যায়, ভাই, আপনি একটা ইন্টারনেটকে বিয়ে করুন।
কিন্তু তা বলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আমি চাইলে ইন্টারনেট অফ হবে বটে, কিন্তু আমার চাইবার শক্তি যে থাকবে না। রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে মনে হবে, যাই না, একটু ফেসবুকটা চেক করি, দেখি না স্ট্যাটাসে কয়টা লাইক পড়ল।

৫.
এই কৌতুক আগেও শুনেছেন। আবার শুনতে পারেন, এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কৌতুক।
গৃহপরিচারিকা কয়েক দিন বিনা নোটিশে অনুপস্থিত থাকল। তারপর কাজে ফিরে এলে গৃহকর্ত্রী তাকে বললেন, তুমি কয়েক দিন কাজে আসোনি, ব্যাপার কী?
‘দেশে গেছিলাম, আপা।’
‘দেশে গেছ। বলে যাবা না?’
‘ক্যান? আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলাম, তিন দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি, আপনে দেখেন নাই?’
‘ওমা! তোমার আবার ফেসবুকও আছে নাকি?’
‘কেন? আপনি জানেন না? আপনার বর তো আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট দিছে: মিস ইউ।’

৬.
তলস্তয়ের থ্রি কোশ্চেনস গল্পে পড়েছিলাম—
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কী?’
‘এখন। এই মুহূর্ত।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী?’
‘এখন যা করছি।’
‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কে?’
‘যিনি এখন আমার সামনে বসে আছেন।’
প্রিয় পাঠক, আমাদের মনে হয় তলস্তয়ের এই গল্পটা আরেকবার গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। এই সময়টাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়, এখন যা করছি, এই কাজটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, আর এখন যিনি আমার সামনে আছেন তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনার সামনে রক্ত-মাংসের যে মানুষটি আছেন, তাঁর কথাই নিশ্চয়ই তলস্তয় বলেছেন, দূরবর্তী শত শত ছায়াবন্ধুর কথা নিশ্চয়ই তিনি বোঝাতে চাননি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
প্রথম আলো | তারিখ: ০৭-০৮-২০১২